শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘে সারাবিশ্বের জন্য একটি শান্তির মডেল উপস্থাপন করেছি, যার নাম হলো 'জনগণের ক্ষমতায়ন ও শান্তির মডেল''প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বলেছেন, বিরোধী দলকে নির্বাচনে আসতেই হবে। যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা জানাতে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে শনিবার এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী দলের সঙ্গে সংসদে আলোচনার পথ খোলা রয়েছে বলেও আবার মন্তব্য করেন হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, "নির্বাচন হবেই, হবেই, হবেই। জনগণ নির্বাচন করবেই, করবেই, করবেই। "উনি (খালেদা) এত কথা বলছেন,,, উনি নির্বাচনে আসবেন। উনাকে নির্বাচনে আসতেই হবে। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে নির্বাচনে আসতেই হবে।" নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান আওয়ামী লীগপ্রধান। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য খালেদা জিয়াকে দায়ী করেন শেখ হাসিনা।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠন করছিল। এমনকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনী কর্ণেল রশিদকে বিরোধীদলের নেতার পদ দিতেও লজ্জা করেনি। বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনী মেজর হুদাকে সংসদ সদস্য বানিয়েছিল। ২০০৬ সালে জোর করে ক্ষমতা দখলের জন্য বিএনপির সাবেক আনত্মর্জাতিক সম্পাদক, সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করতে বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়েছিল।১ কোটি ২৩ লক্ষ ভুয়া ভোটার দিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ৫৮(গ) অনুচ্ছেদ যথাযথভাবে অনুসরন না করে আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীনকে প্রধান উপদেষ্টা করে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর অপচেষ্টা করেছিল। দেশে নেমে এসেছিল ১/১১ এর দুর্যোগ, আতংকের শাসন।
খালেদা জিয়ার দুর্নীতি, ক্ষমতার লোভ ও অপকর্মের ফসল ছিলো বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেসময়ে দেশে যে আতংকের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি বাংলাদেশের কোন গণতন্ত্রকামী মানুষ আর দেখতে চায় না।
বিএনপির নেত্রী ২০০৭ সালের পহেলা জুলাই নিউইয়র্কে পৃথক দুটি টেলিকনফারেন্সে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, " জনগণই একদিন এই ব্যবস্থার বিলুপ্তি চাইবে"।জনগণ বিলুপ্তি চায় বলেই আমরা সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে নির্বাচিত জাতীয় সংসদে এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেছি।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরকারের উদ্দেশে ফাইনাল খেলার প্রস্তুতি নেওয়ার যে আহ্বান জানিয়েছেন—এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেমিফাইনাল না খেলেই ফাইনাল খেলা কীভাবে হবে? তিনি বলেন, 'খেলনেওয়ালারা খেলে যাবেন। কাজ করনেওয়ালারা কাজ করে যাবেন। আমরা কাজ করে যাচ্ছি।' প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিবাজ ছেলে ও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর আন্দোলন বাদ দিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানান।
২৭ সেপ্টেম্বর জনসভায় বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য ছিল গতানুগতিক। তিনি বললেন, দেশের মানুষ অশান্তিতে আছে। আসলে নিজে সারাক্ষণ অশান্তিতে ভোগেন। ক্ষমতা থেকে বিদায় হওয়ার কষ্ট তার আছে। দুই দুর্নীতিবাজ সন্তানদের লুটপাটের সুযোগ বন্ধ হওয়ার কষ্ট তার আছে। তাই বলেছেন, দেশে এখন অশান্তি। তিনি বলেছেন, দেশে নাকি গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্র নাকি অবরুদ্ধ। গণতন্ত্র অবরুদ্ধ হলে তিনি সমাবেশ করলেন কিভাবে? তার রাজনীতির লক্ষ্য, দুই দুর্নীতিবাজ ছেলেকে বিচারের হাত থেকে বাঁচানো।একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, লাখো শহীদের হত্যাকারীদের রক্ষা করা।তিনি বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি মানেননা। এটাই স্বাভাবিক। কারন, তার স্বামী জিয়া এই যুদ্ধঅপরাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছিলেন। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে রাজাকারদের গাড়ীতে জাতীয় পতাকা দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। মানুষ আমাদের ম্যান্ডেট দিয়েছে। তাদের বিচার আমরা করবোই।
শেখ হাসিনা বলেন, খালেদা জিয়া তার দুর্নীতিবাজ সন্তানদেরদের রক্ষা করতে চাইছেন। তার সন্তানদের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার ঘটনা আমেরিকার ফেডারেল কোর্ট ও সিঙ্গাপুরের আদালতে প্রমাণিত হওয়ার পরেও তিনি বড় কথা বলেন। এরা এমনকি জিয়ার নামে ট্রাষ্ট করে এতিমদের জন্য টাকা এনে সেই টাকা আত্মসাৎ করেছে। এদের দুর্নীতির জন্যই বিএনপি-জামাতের ৫ বছরে বাংলাদেশ পরিচিত ছিলো দুর্নীতির বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসাবে।
ভাঙা সুটকেস আর ছেড়াঁ গেঞ্জির ভিতরে কি এমন আলাদিনের চেরাগ ছিলো যে তিনি, তার সন্তান আর ভাইয়েরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হলেন? দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করেন তখন তার মুখে ভালো কথা মানায়না। কথায় আছে,- "চোরের মার বড় গলা"।
খালেদা জিয়া বলেছেন, আমরা নাকি সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস উঠিয়ে ফেলেছি। খালেদা জিয়া কি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এর মানে জানেননা ? আল্লাহর উপর বিশ্বাস না থাকলে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংবিধানে থাকে কিভাবে?
খালেদা জিয়া দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা বলেছেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা বলার আগে তাকে জবাব দিতে হবে - যে চাল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালে ১০ টাকা কেজি রেখে এসেছিল তা কেন তার সময়ে ৪৫ টাকা কেজি হয়েছিল? ২০০৮ সালে যে চালের দাম ছিলো ৪৫ টাকা বর্তমানে ৩৫ টাকা। প্রতিবেশী দেশগুলোর দ্রব্যমূল্যের সাথে তুলনা করুন। তারপর কথা বলুন। আমরা সরকার গঠনের পর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। নতুন জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণা করা হয়েছে। যার বেতন ছিলো ৩ হাজার টাকা তা হয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যুনতম বেতন ১৬০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেয়েছে। আয় বেড়েছে। বিদেশ থেকে ৪২ টাকা কেজি দরে চাল কিনে গরীবদের মধ্যে ২৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। রোজার মাসে হতদরিদ্রদের মাঝে বিনামূল্যে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। ভিজিএফ, ফেয়ার প্রাইস কার্ড, রেশনিং এর মাধ্যমে গরীব মানুষকে সাহায্য করা হচ্ছে। খালেদা বলেছেন, ক্ষমতায় এলে নাকি বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করবেন। মানুষ ভুলে যায়নি তার সনত্মানেরা এইখাত থেকে কিভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। বি.এন.পি জামাত ৫ বছরে এক মেগাওয়াট উৎপাদন বাড়াতে পারেনি বরং কমিয়েছে। বিদ্যুৎ আমাদের সরকারের অগ্রাধিকার খাত।আড়াই বছরে ২২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন বাড়িয়েছি।২২টি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হয়েছে।৩৪টির কাজ চলছে।প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। পূরণ করছি। তাদের সময়ের ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে। খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশের অর্থনীতি নাকি খুব খারাপ অবস্থায়। এবছর প্রবৃদ্ধি ৬.৭ ভাগ।গড় আয় বেড়ে ৮২৮ টাকা।বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বেড়েছে ৩০%। রফতানি বেড়েছে ৪২%। এরপরেও অর্থনীতির অবস্থা কিভাবে খারাপ হয়? বিরোধীদলের নেতা তাদের সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়নি বলে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। বিগত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময়ে সর্বমোট ৯ বার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। ২০০১ সালে যে ডিজেল রেখে এসেছিলাম ১৫ টাকা ৫০ পয়সা লিটার তা বাড়িয়ে দ্বিগুণেরও বেশী অর্থাৎ ৩৩ টাকা করেছিলেন। ২৫ টাকার অকটেন করেছিলেন ৫৮ টাকা। সাড়ে ১৫ টাকার কেরোসিনের দাম করেছিলেন ৩৩ টাকা। মানুষ এসব ভুলে যায়নি।
আনত্মর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারনে এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কারনে এবারের দাম বাড়ানোর পরেও শুধু এই বছরেই সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে ১৪ হাজার ৫শত কোটি টাকা।
খালেদা জিয়া কি চাননা বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হোক? আইন-শৃংখলা পরিসি'তি নিয়ে কথা বলেছেন। তার কাছে আমার প্রশ্ন, র্যা ব কাদের সৃষ্টি? তিনি র্যাইব ও পুলিশকে ট্রেনিং না দেয়ার জন্য বিদেশীদের কাছে আহবান জানিয়েছেন। খালেদা জিয়ার ইচ্ছা কি ? জনগণকে নিরাপত্তাহীন করা? দেশকে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত করা? জঙ্গীদের কাছে বাংলাদেশকে জিম্মি করা? আমাদের আড়াই বছরে একই সময়ে ৫০০ স্থানে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেনি।
বিরোধীদলীয় নেতার উপর গ্রেনেড হামলা হয়নি। বিরোধীদলের কোন এমপি নিহত হয়নি। ধর্ষণ, বাড়ী ঘর দখল হয়নি ।
তাদের সময়ে কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা, অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরি হত্যা। বাবার কোলে শিশু নওশীন হত্যা, ছাত্রদল ক্যাডারদের হাতে বুয়েটের ছাত্র সনি হত্যা, বগুড়ায় মসজিদে কোরান তেলাওয়াতরত অবস্থায় আজম হত্যার কথা মানুষ ভুলে যায়নি। পাবনায় ২০০ খ্রীষ্টান পরিবারের জমি দখল, খাগড়াছড়িতে বৌদ্ধ মন্দির দখল,বাগেরহাটে একই সংখ্যালঘু পরিবারের ৯ জনকে হত্যা বিএনপি-জামাত আমলের আইন-শৃংখলা পরিসি'তির নমুনা।
ছবিরানী, মাহফুজা, পূর্ণিমা, বেদানা, রজুফা, ফাহিমা, মহিমা ধর্ষণ, ভোলায় একরাতে একশ নারীকে গণধর্ষণ, নেত্রকোণার কেন্দুয়ায় এক রাতে ৭০ জন নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণ, গফরগাঁয়ে আওয়ামী লীগ কর্মী মোজাম্মেল এর ভিটেমাটি কেটে পুকুর বানানোর কথা এদেশের মানুষ কখনো ভুলবেনা। ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট আওয়ামী লীগের শানিত্মপূর্ণ সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আইভি রহমানসহ ২২ জন নেতা-কর্মীকে কারা হত্যা করেছিল তা আজ তদনেত্মর মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে।
অন্যদিকে যখনই আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে তখনই বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের কাছ থেকে আমাদের ন্যায্য পাওনা আদায় করেছে। সীমান্ত প্রটোকল স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারতের সাথে আমাদের স্থলসীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরফলে আমরা ১৭ হাজার একর জায়গা ভারতের কাছ থেকে পেয়েছি। তিনবিঘা করিডোর দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলের বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য সার্বক্ষনিক খুলে দেয়া হয়েছে। এরফলে ৩৭ বছরের বেশী সময় ধরে ঝুলে থাকা ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। ভারতে বাংলাদেশের ৪৬ টি পন্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিচুক্তির মাধ্যমে আমাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করেছিলো । তিস্তার পানি নিয়েও আলোচনা চলমান। আমরা আশাবাদী, আলোচনার মাধ্যমে সম্ভাব্য দ্রুত সময়ের মধ্যেই এসমস্যার সমাধান করবো ।
তিনি বলেন, ২০ সেপ্টেম্বর সকালে Clinton Global Initiative এবং সদ্য সমাপ্ত ঈঙচ-১৬ এর আয়োজনকারী দেশ মেক্সিকো এবং COP-17 -১৭ এর আয়োজনকারী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপ্রধানগণ কর্তৃক আয়োজিত জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক বিশ্বনেতাদের সংলাপে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সরকারপ্রধান হিসাবে দেওয়া ভাষণে আমি জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি পৃথিবীকে রক্ষা করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। এসময় আমি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ সমূহ তুলে ধরি এবং সাম্যতা এবং আনত্মর্জাতিক দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে এর আশু সমাধানে আনত্মর্জাতিক গোষ্ঠীকে আহ্বান জানাই।
সেদিন দুপুরে ইউএস চেম্বার ও এশিয়া সোসাইটি আয়োজিত মধ্যাহ্ন ভোজসভায় আমি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার আহবান জানাই। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশ মঞ্জুর করতে ইতিবাচক ভূমিকা পালনের জন্য বন্ধুপ্রতিম মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সহযোগিতা চেয়েছি। বাংলাদেশে আরো বিনিয়োগ করতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানাই।
২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ অ্যাসেম্বলি হলে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন আয়োজিত "প্রত্যেক নারী ও প্রত্যেক শিশু" শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেই। নারী ও শিশুর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সম্মিলিত অঙ্গীকার জোরদার করতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানাই। আমি বিশ্বাস করি, নারী ও শিশুর কল্যাণের ওপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যত। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের তুলনায় শিশু মৃত্যুর হার (আইএমআর) ৬৬ শতাংশে হ্রাস করেছে। এক্ষেত্রে এমডিজি-৪-এর আইএমআর অর্জনের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের তুলনায় মাতৃমৃত্যুর হার (এমএমআর) ৪৫ শতাংশে হ্রাস করেছে এবং বর্তমানে আমরা এমডিজি-৫-এর এমএমআর অর্জনের পথে রয়েছি। ৬টি প্রতিরোধযোগ্য ব্যাধি নির্মূলে সমপ্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশ পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুমৃত্যু হার হ্রাসে সাফল্য অর্জন করেছে। আমরা ই-হেলথ সার্ভিসের মাধ্যমে ডায়রিয়া প্রতিরোধেও সাফল্য অর্জন করেছি। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব মা ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের সরকারের সাফল্যের প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, ২১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। সেদিন সকালে কাতারের আমীর শেখ হামাদ বিন খলিফা আল-থানির সঙ্গে বৈঠকে আমি বাংলাদেশে কাতারের বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও এদেশ থেকে আরও জনশক্তি নিতে কাতার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। এদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথেও আমার দুদফা কুশল বিনিময় হয়। দুপুরে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের দেয়া মধ্যাহ্ন ভোজসভায় প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে আমার সাক্ষাত হয়। সন্ধ্যায় ফার্ষ্ট লেডি মিশেল ওবামার দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ওবামাসহ অন্যান্য বিশ্বনেতৃবৃন্দের সাথে আবার কুশল বিনিময় হয়। এসময় প্রেসিডেন্ট ওবামা নারীর ক্ষমতায়ন ও জঙ্গিবাদ দমনে আমাদের সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করেন। বাংলাদেশ সফরে তিনি তার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ২২ সেপ্টেম্বর Economic empowerment of rural women and food and nutrational security অর্থাৎ 'গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং খাদ্য ও পুষ্টিগত নিরাপত্তা' শীর্ষক এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করি। এই সেমিনারের মূল উদ্যোক্তা ছিল বিশ্ব খাদ্যসংস্থা, ইউনাইটেড ন্যাশন্স উইমেন ও নেদারল্যান্ডস সরকার। সেমিনারে গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন সফলতার জন্য বাংলাদেশ সবার প্রশংসা অর্জন করে। আমার প্রবন্ধে আমি উল্লেখ করি যে, বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র ও সমাজের সব স-রে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সরকারি নীতি-কৌশল নারীর ক্ষমতায়নকে সব উন্নয়ন এজেন্ডার কেন্দ্রে স্থাপন করেছে। আমরা বিশ্বাস করি দারিদ্র্য ও ক্ষুধা হ্রাস করা জেন্ডার সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নত মাতৃস্বাসে'্যর লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এদিন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৬তম অধিবেশনের সভাপতি নাসির আব্দুল আজিজ আল নাসেরের সাথে আমার বৈঠক হয়।
২৩ সেপ্টেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সাথে আমার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এদের মধ্যে রয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, সৌদী পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স সউদ আল ফয়সল, কমনওয়েলথ মহাসচিব কমলেশ শর্মা, জাতিসংঘের নবীনতম সদস্য দক্ষিণ সুদানের প্রেসিডেন্ট সালভা কির মায়ারডিপ, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রেসেপ তায়েপ এরদুগান এবং মালদ্বীপের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ডঃ মোহাম্মদ ওয়াহেদ।
জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সাথে বৈঠকের সময়ে তিনি এমডিজি অর্জনে আমাদের সরকারের অগ্রযাত্রার প্রশংসা করেছেন। আমি তাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালে তিনি তা গ্রহণ করেন।
২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আমি বাংলাদেশের কান্ট্রি ষ্টেটমেন্ট প্রদান করি। আমি আমার বক্তব্যে বলেছি, শান্তিই হচ্ছে উন্নয়নের সোপান। আর শানিত্ম তখনই বিরাজ করে, যখন ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ''সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়'' এবং ''সকল বিরোধের শানিত্মপূর্ণ সমাধান'' নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সাঁইত্রিশ বছর আগে জাতিসংঘের মঞ্চ থেকেই তিনি একথা উচ্চারণ করেছিলেন।
সেই ধারাবাহিকতায় শানিত্মর জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা আমাদের সরকারের অভ্যনত্মরীণ এবং বৈদেশিক নীতির অন্যতম সত্মম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
আমার সরকারের শান্তিপূর্ণ মধ্যস'তার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম শানিত্মচুক্তি, ভারতের সাথে গঙ্গা পানি চুক্তি, বিডিআর বিদ্রোহ নিরসন এবং সমপ্রতি বাংলাদেশ-ভারতের দীর্ঘ ৪০ বছরের সীমানত্ম বিরোধের অবসান ইত্যাদি উদাহরণ তুলে ধরি।
জাতিসংঘের ৬৬ তম অধিবেশনমঞ্চে দাঁড়িয়ে আমি সারাবিশ্বের জন্য একটি শান্তির মডেল উপস্থাপন করেছি যার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে জনগণের ক্ষমতায়ন। এটি একটি বহুমাত্রিক ধারণা যেখানে গণতন্ত্র এবং উন্নয়নকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া হয়েছে। এতে আছে ছয়টি পরস্পর ক্রিয়াশীল বিষয় যা শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
এগুলো হচ্ছে (১) ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ (২) বৈষম্য দূরীকরণ, (৩) বঞ্চনার লাঘব, (৪) ঝড়েপড়া মানুষদের সমাজের মূলধারায় অনত্মর্ভুক্তি, (৫) মানবসম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং (৬) সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন।
আমি এর নাম দিয়েছি ''জনগণের ক্ষমতায়ন ও শান্তির মডেল''। এর মূল বিষয় হচ্ছে সকল মানুষকে সমান চোখে দেখা এবং মানবিক সামর্থ্য উন্নয়নের কাজে লাগানো। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি জেনেছি যে, জনগণের ক্ষমতায়ন ছাড়া শান্তি ও উন্নয়ন অসম্ভব। বিশ্বনেতাদের প্রতি এই শান্তিরর মডেলটি প্রয়োগ করার আহবান জানিয়েছি।
২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে"A culture of peace" নামে Annual Flagship Resolution উপস্থাপন করেছিলাম। এবার আমার শানিত্মমডেলের আলোকে বাংলাদেশ জনগণের ক্ষমতায়ন শীর্ষক একটি নতুন রেজুলুশন ৬৬ তম অধিবেশনে পেশ করেছে।
এ প্রসঙ্গে আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, ২০০০ সালে জাতিসংঘের মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট সামিটে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আমি নির্বাচিত সরকারকে অবৈধভাবে উৎখাতের অগণতান্ত্রিক ধারার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার আহবান জানিয়েছিলাম।
আনত্মঃরাষ্ট্র জাতিগত সংঘাত নিরসন, সন্ত্রাসবাদ দমন, আনত্মঃসীমানা অপরাধ দমন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলা, দারিদ্র্য বিমোচন, পানি ও জ্বালানি নিরাপত্তা তৈরি এবং ধনী ও গরীবের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য বিলোপে জাতিসংঘকে আরো কার্যকর করার কথা বলেছি।
আপনারা জানেন, জাতিসংঘ শানিত্মরক্ষী বাহিনীতে ছত্রিশটি দেশের বায়ান্নটি মিশনে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত এক লাখ বাইশ হাজার চুরানব্বই জন শানিত্মরক্ষী প্রেরণ করেছে। এসব মিশনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের ১০৩ জন শানিত্মরক্ষী শহীদ হয়েছেন।
বিশ্বের প্রায় তিনশো মিলিয়ন মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। আমি বাংলাভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দিতে আমাদের আবেদনের প্রতি সকলের সমর্থন কামনা করছি। এছাড়াও আমার বক্তৃতায় আমি ক্ষুধা, দারিদ্র ও অশিক্ষার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সাহসী সংগ্রাম ও সাফল্যের কথা তুলে ধরেছি।
বিশেষ করে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আমাদের গৃহীত পদক্ষেপ, জ্বালানি নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা মোকাবেলায় আমাদের উদ্যোগ ও নারীর আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে আমাদের সাফল্য সবার প্রশংসা অর্জন করেছে।
আমি বলেছি, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এজন্যই ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য একটি স্বাধীন আনত্মর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমাদের গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সনদের অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে আমরা অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ। অতীত ভুলের সংশোধনের এটিই একমাত্র পথ। এর মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য সুসংহত হবে।
আমি এবং আমার পরিবার বারবার সন্ত্রাসের শিকার হয়েছি। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট এবং ২০০৪ সালের ২১ আগষ্টের ভয়াবহতা থেকে আমি জানি, সন্ত্রাস কিভাবে গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে ধবংস করে দেয়। তাই সন্ত্রাস নির্মুলে আমি আমার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছি।
এবারের নিউইয়র্ক সফরকালে বিভিন্ন আনত্মর্জাতিক মিডিয়া যেমন, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট এবং ভয়েস অব আমেরিকা পৃথকভাবে আমার সাক্ষাৎকার নেয়। এসব সাক্ষাৎকারে আমি সমসাময়িক পরিসি'তি বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন, আঞ্চলিক ও আন-র্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ডিজিটাল বাংলাদেশ, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রসঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরেছি।
২৪ সেপ্টেম্বর বিকালে আমি নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশ ও জাতির কল্যাণে আমাদের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরি। ২৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ার জোসেফ ক্রাউলি আমার সাথে সাক্ষাত করেন। বিকালে প্রবাসীদের দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেই। এসময়ে আমি তাদের প্রতি বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তাদেরকে শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করার আহ্বান জানাই। দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অবদানের কথা স্মরণ করে বাংলাদেশে তাদেরকে আরো বেশি করে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আহবান জানিয়েছি। প্রবাসীদের বিপুল উচ্ছাস ও আনন্দের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসি আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করি।
তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এই অধিবেশনে যোগ দিয়ে এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে অংশ নেয়ার মাধ্যমে আমি চেষ্টা করেছি বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের উদার, শান্তিকামী ও গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে। ক্ষুধা, দারিদ্র, অশিক্ষা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী চলমান সংগ্রামে আমরা বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে রোলমডেল হিসাবে তুলে ধরতে চাই। এই সফরে আমি আনত্মরিকভাবে সেই চেষ্টাই করেছি। বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছি শান্তির মডেল যার মাধ্যমে অর্জিত হবে আর্ত-মানবতার মুক্তি।
No comments:
Post a Comment